জেনেভা কনভেনশন অনুসারে যুদ্ধের সময় বেসামরিক জনসাধারণের নিরাপত্তা এবং যুদ্ধবন্দীদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কে লিখ


প্রশ্নঃ যুদ্ধের সময় বেসামরিক জনসাধারণের নিরাপত্তা এবং যুদ্ধবন্দীদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কে ১৯৪৯ সালের জেনেভা চুক্তি বা কনভেনশন আলোচনা কর।

ভূমিকাঃ যুদ্ধ এমনি এক বিষয় যা কেউ কামনা করে না। তবে যুদ্ধ বললে শুধু ধ্বংস বা ক্ষতির বিষয়টি সামনে আসে। কিন্তু যুদ্ধ কোন পক্ষের জন্য মঙ্গলও বয়ে আনে। অর্থাৎ যুদ্ধ কখনো কখনো অনিবার্য হয়ে পড়ে। যুদ্ধের বিকল্প আর কোন পথ থাকে না।

যুদ্ধের সময় বেসামরিক জনসাধারণের নিরাপত্তা এবং যুদ্ধবন্দীদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কে ১৯৪৯ সালের জেনেভা চুক্তি বা কনভেনশনঃ নিম্নে ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধের সময় বেসামরিক জনসাধারণের নিরাপত্তা এবং যুদ্ধবন্দীদের প্রতি ব্যবহার সম্পর্কে আলোচনা করা হলো- 

(১) হাসপাতাল এবং নিরাপদ স্থান তৈরি : যুদ্ধের সময় বা শান্তিকালীন সময়ে নিজ এলাকায় বা দখলকৃত এলাকায় আহত মানুষের সেবার জন্য, ১৫ বছরের কম বয়স্ক বালক- বালিকাদের, গর্ভবতী মহিলাদের নিরাপত্তার জন্য হাসপাতাল ও নিরাপদ স্থান তৈরি করতে হবে। [অনু-১৪]

(২) হাসপাতাল এলাকায় আক্রমণ না করা : যুদ্ধের সময় কোন অবস্থাতে হাসপাতাল এলাকায় আক্রমণ করা যাবে না। [অনু-১৮]

(৩) হাসপাতালের কর্মীদের নিরাপত্তা : হাসপাতালে বিভিন্ন কাজে যারা নিয়োজিত তাদের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। [অনু-২০]






(৪) স্থানান্তর কাজে বা চিকিৎসা কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিরাপত্তা :
 স্থানান্তর কাজে বা চিকিৎসা কাজে যে সকল ব্যক্তিবর্গ নিয়োজিত তাদের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। [অনু-২২] 

(৫) সামাজিক অধিকার রক্ষা : রক্ষিত ব্যক্তিদের সামাজিক মর্যাদা, পারিবারিক অধিকার, ধর্মীয় রীতি ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। [অনু-২৭]

(৬) সামরিক এলাকায় নিয়োগ না করা : রক্ষিত ব্যক্তিদেরকে সামরিক এলাকায় কোন কাজে নিয়োগ করা যাবে না। [অনু-২৮]

(৭) রক্ষিতদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত না করা : এমন কোন কাজ করা যাবে না যারফলে রক্ষিত ব্যক্তিদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। [অনু-৩২]

(৮) অন্য রাষ্ট্রে প্রেরণ না করা : রক্ষিত ব্যক্তিদেরকে জোরপূর্বক অন্য কোন রাষ্ট্রে প্রেরণ করা যাবে না। [অনু-৪৯]






(৯) শিশু পরিচর্যার প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা প্রদান :
 যে সকল প্রতিষ্ঠান শিশুদের লালন-পালন বা পরিচর্যার কাজে নিয়োজিত সেই সকল প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করতে হবে। [অনু-৫০]

(১০) খাদ্য ও ঔষধ সরবরাহ করা : দখলকারী রাষ্ট্র দখলকৃত এলাকার অধিবাসীদের প্রয়োজনীয় খাদ্য ও ঔষধ সরবরাহ করবে। [অনু-৫৫]

(১১) আইনী সহায়তা প্রদান : দখলকৃত অঞ্চলের কোন ব্যক্তির বিচার শুরু হলে তাকে সাক্ষ্য প্রমাণ হাজীর করার বা কৌশলীর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ দিতে হবে। [অনু-৭৩]

যুদ্ধবন্দীদের সাথে ব্যবহার বা তাদের তত্ত্বাবধানঃ জেনেভা কনভেনশন-১৯৪৯ অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদের সাথে ব্যবহার বা তাদের তত্ত্বাবধান নিয়ে উল্লেখ করা হলো :

(১) মানবিক আচরণ : যুদ্ধবন্দীদের সাথে মানবিক আচরণ করতে হবে। তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করতে হবে। [অনু-১২]

(২) প্রতিশোধ না নেয়া : যুদ্ধবন্দীর উপর প্রতিশোধমূলক কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। বরং তাদেরকে হেফাজতে রাখতে হবে। [অনু-১৩]

(৩) ব্যবহার্য বস্তু দখল না করা : যুদ্ধবন্দীদের ব্যক্তিগত ব্যবহার্য বস্তু যেমনঃ বিভিন্ন সরঞ্জাম, ঘোড়া, দলিল ইত্যাদি দখল করা যাবে না। [অনু-১৭]

(৪) নিরাপদ স্থানে রাখা : যুদ্ধবন্দীদেরকে নিরাপদ স্থানে রাখতে হবে। [অনু-১৯]

(৫) খাদ্য ও পোশাক : যুদ্ধবন্দীদের পর্যাপ্ত খাদ্য প্রদান করতে হবে যার ফলে তাদের স্বাস্থ্য ঠিক থাকে। প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের পোশাক, জুতা ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। 

(৬) চিকিৎসা প্রদান : যুদ্ধবন্দীদেরকে এমনভাবে চিকিৎসা প্রদান করতে হবে যেন সেখানে কোন রোগের প্রাদুর্ভাব না হয়। [অনু-২৯]

(৭) স্থানান্তর : যুদ্ধবন্দীদের ইচ্ছার প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদেরকে স্থানান্তর করা যাবে। এক্ষেত্রে মানবিক বিষয় এবং তাদের যেন দুর্ভোগ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। [অনু-৪৬] 

(৮) নিয়োগ : যুদ্ধবন্দীদের বয়স, স্বাস্থ্য, পুরুষ, নারী ইত্যাদি বিবেচনা করে তাদের উপযোগী কাজে নিয়োগ দেয়া যাবে। [অনু-৪৯]

(৯) পারিশ্রমিক : যুদ্ধবন্দীদের পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে এবং নির্দিষ্ট হারে এক মাসের বেতন অগ্রিম প্রদান করতে হবে। [অনু-৬০-৬৩]

(১০) চিঠি প্রেরণের সুযোগ : যুদ্ধবন্দীদেরকে প্রতিমাসে কমপক্ষে দু'টি চিঠি প্রেরণের সুযোগ দিতে হবে। [অনু-৬৪]

(১১) শাস্তি : কোন আদালতের বৈধ কার্যপদ্ধতি ব্যতীত শাস্তি প্রদান করা যাবে না। [অনু-৯৯] 

(১২) দোভাষী : যুদ্ধবন্দী প্রয়োজনে দোভাষীর সাহায্য নিতে পারবে। [অনু-১০০] 

(১৩) আহতদের স্বদেশে প্রেরণ : যুদ্ধে গুরুতর আহতদের স্বদেশে প্রেরণ করতে হবে। তবে যুদ্ধ চলাকালীন সময় তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার স্বদেশে প্রেরণ করা যাবে না। [অনু-১০৯] 

(১৪) যুদ্ধ শেষে দেশে প্রেরণ : যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবন্দীদেরকে মুক্তিদান করে যতদ্রুত সম্ভব দেশে প্রেরণ করতে হবে। [অনু-১১৮]

(১৫) মৃতদেহের সৎকার : বন্দী থাকা অবস্থায় কোন যুদ্ধবন্দীর মৃত্যু হলে তার ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সৎকার করতে হবে। তার সমাধি এমনভাবে চিহ্নিত করতে হবে যেন পরে খুঁজে পাওয়া যায়। [অনু-১২০]

উপসংহারঃ যুদ্ধ কারো কাম্য নয়। তবুও কোন কারণে যুদ্ধ সংঘটিত হলে যুদ্ধের নিয়ম মেনে যুদ্ধ করতে হয়। এসময় নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ্য ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। এই সকল বিষয় না মানা হলে পরবর্তীতে তাদেরকে অপরাধী হিসেবে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়।

Post a Comment

Leave a Comment.