প্রশ্নঃ সমাজকাঠামো হচ্ছে প্রধান প্রধান গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের জটিল সম্পর্ক (জিন্সবার্গ) আলোচনা কর।
অথবা, সমাজকাঠামো হলো ‘সমাজকে রূপায়ণ করে এমন প্রধান প্রধান গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের যৌগিক বিন্যাস (জিন্সবার্গ) উক্তিটি পরীক্ষা কর।
ভূমিকাঃ মানবসত্তার সূচনাতেই সমাজ নামক প্রত্যয়টির যেমন আবির্ভাব ঘটেছে তেমনই সমাজবিজ্ঞানের সূচনালগ্ন থেকে সমাজকাঠামো বিষয়টি কেন্দ্রীয় প্রত্যয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আধুনিক সমাজকাঠামো একটি মৌল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে গণ্য। সমাজবিজ্ঞানের প্রতিটি স্তরের আলোচনায় সমাজকাঠামোর বিষয়টি সর্বদাই তাৎপর্যপূর্ণ। আর এটির অবস্থানই অন্যান্য সামাজিক বিজ্ঞান থেকে সমাজবিজ্ঞানকে স্বতন্ত্র করেছে। সর্বপ্রথম হারবার্ট স্পেনসার জীবদেহের কাঠামোর সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজতে সমাজকাঠামো প্রত্যয়টি ব্যবহার করেন। এটা একটি বিমূর্ত ধারণা। একে চোখে দেখা যায় না বা স্পর্শ করা যায় না। তবে সমাজের নিজস্ব কাঠামো বা গড়ন রয়েছে।
সমাজকাঠামোর সংজ্ঞাদানের দৃষ্টিভঙ্গির সংজ্ঞা এবং তার সমালোচনার প্রেক্ষাপটে জিন্সবার্গের সংজ্ঞার মূল্যায়ণ সমাজকাঠামোর ধারণা তথা সংজ্ঞার ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানী ও নৃ-বিজ্ঞানীর মধ্যে মতান্তর পরিলক্ষিত হয়। কেননা তারা সমাজকাঠামোর পরিচয় দিতে গিয়ে সমাজের বিভিন্ন দিকের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের আলোকে সমাজকাঠামো বিষয়টিকে চারভাবে সংজ্ঞায়িত করা হলোঃ
(i). Social Relationship [সামাজিক সম্পর্ক ]
(ii). Social Organization [সামাজিক সংগঠন]
(iii). Social Role [সামাজিক ভূমিকা]
(iv). Distribution of Power [ রাজনৈতিক ক্ষমতা]
crossorigin="anonymous">
style="display:block; text-align:center;"
data-ad-layout="in-article"
data-ad-format="fluid"
data-ad-client="ca-pub-3850092454288730"
data-ad-slot="2569077421">
i. Social Relationship (সামাজিক সম্পর্ক): সামাজিক সম্পর্ক নৃ-বিজ্ঞানী Redceelle Brown তার Structure and foundation in primitive society নামক গ্রন্থে বলেছেন, আমরা যখন সমাজকাঠামো সমীক্ষা করি তখন একটি নির্দিষ্ট সময়ে কিছুসংখ্যক মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধত্বপূর্ণ হিসেবে বিদ্যমান সম্পর্কের বাস্তব অবস্থানটিকে অনুধাবন করতে চাই।
সমালোচনাঃ Brown-এর উক্ত সংজ্ঞার সমালোচনায় Ray Mond Firth বলেন, এই সংজ্ঞাটি অতি ব্যাপক। এতে সামাজিক ক্রিয়ার স্থায়ী ও অস্থায়ী উপাদানের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। এর ফলে সমাজ এবং সমাজকাঠামোর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে যায়।
ii. Social Organization (সামাজিক সংগঠন): Morls Ginberg বলেন, সমাজকাঠামো হলো সমাজকে রূপায়ণ করে এমন প্রধান প্রধান সামাজিক গোষ্ঠী ও অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের যৌগিক সমন্বয়।
সমালোচনা: যদিও বুর্জোয়া সমাজবিজ্ঞানীদের মতে এ সংজ্ঞাটি অধিকতর বাস্তবসম্মত ও মোটামুটি গ্রহণযোগ্য তথাপি এর বক্তব্যে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। সামাজিক সংগঠন, প্রতিষ্ঠান, সংঘ ও গোষ্ঠির মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করা কষ্টসাধ্য এবং এদের প্রাধান্য নিরূপণ করার দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত।
crossorigin="anonymous">
style="display:block; text-align:center;"
data-ad-layout="in-article"
data-ad-format="fluid"
data-ad-client="ca-pub-3850092454288730"
data-ad-slot="2569077421">
iii. Social Role ( সামাজিক ভূমিকা): সামাজিক ভূমিকা সমাজবিজ্ঞানী সামাজিক ভূমিকার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজকাঠামো সংজ্ঞায়িত করেছেন। S.F Nadel বলেন- “সমাজকাঠামো হলো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সদস্যের পারস্পরিক সম্পর্কের একটি রূপ যা তাদের ভূমিকার মধ্যদিয়ে প্রতিভাত হয়।
সমালোচনা: সমাজবিজ্ঞানী Bottomore এই সংজ্ঞার সমালোচনা করেছেন। যদিও সংজ্ঞাটিতে ভূমিকার ধারণা ব্যবহারের মধ্যে কিছু সুবিধা রয়েছে তথাপি ভূমিকা অধিক গুরুত্ব পেলে সামাজিক আচরণ অতিমাত্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যাখ্যার সম্ভাবনা থাকে। এতে সামাজিক গোষ্ঠী উপেক্ষিত হয়।
iv. Distribution of Power (রাজনৈতিক ক্ষমতা): সমাজবিজ্ঞানী E.R. Leach সমাজকাঠামোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর গুরুত্ব দেন। তার মতে, ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন সম্পর্কিত ধারণা নিয়ে সমাজকাঠামো রূপ লাভ করেছে।
সমালোচনাঃ এ সংজ্ঞার সমালোচনা করতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী Shan বলেন, ক্ষমতা একটি Political concept এবং এর সাথে সঙ্গত কারণেই অর্থনীতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা আবশ্যক। কিন্তু Leach তার সংজ্ঞায় এ প্রসঙ্গটি স্পষ্ট করেননি।
crossorigin="anonymous">
style="display:block; text-align:center;"
data-ad-layout="in-article"
data-ad-format="fluid"
data-ad-client="ca-pub-3850092454288730"
data-ad-slot="2569077421">
পর্যালোচনাঃ সমাজকাঠামো সম্পর্কিত উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলো পর্যালোচনা করে আমরা নিম্নোক্ত ধারণাগুলো পাই। যথাঃ
(১) সমাজকাঠামোর ধারণাটি প্রধানত দু'টি ধারায় বিভক্ত। তা হলো জৈবিক বা অজৈবিক।
(২) জৈবিক ধারণা মতে, সমাজের গড়নের মধ্যে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ জীবদেহের মতো পরস্পর অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ । আবার জীবদেহের মতোই সমাজকাঠামোর বিভিন্ন অংশকে বিচ্ছিন্ন করা যায়।
(৩) বুর্জোয়া সমাজবিজ্ঞানীদের নিকট প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠী প্রাধান্য পাওয়ায় সংজ্ঞাটি অধিকতর বাস্তবসম্মত ও গ্রহণযোগ্য। সিদ্ধান্ত ৪ সংজ্ঞা প্রদানের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে মরিস জিন্সবার্গ কর্তৃক প্রদত্ত উক্তিটির বেশি গ্রহণযোগ্যতা খুঁজে পাওয়া যায়।
সমাজকাঠামোর উপাদান এবং জিন্সবার্গের উক্তির যথার্থতাঃ একটা চেয়ার বা একটা বিল্ডিং যেমন কতকগুলো উপাদান দ্বারা তৈরি, তেমনি সমাজকাঠামোরও কতকগুলো উপাদান আছে। সমাজকাঠামোর সাথে জিন্সবার্গের উক্তির যথার্থতা নিরূপণে সমাজকাঠামোর উপাদান আলোচনা করা হলো।
crossorigin="anonymous">
style="display:block; text-align:center;"
data-ad-layout="in-article"
data-ad-format="fluid"
data-ad-client="ca-pub-3850092454288730"
data-ad-slot="2569077421">
প্রথমত, সমাজবদ্ধ মানুষ ছাড়া কোনো সমাজের কথা কল্পনাই করা যায় না । প্রত্যেক মানুষ সমাজে বাস করতে গিয়ে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে । সুতরাং সমাজবদ্ধ মানুষ ও তাদের ভূমিকাকে সমাজকাঠামোর উপাদান হিসেবে গণ্য করা যায় । আর এ জন্যই নেভেল সমাজের মানুষদের ভূমিকার ওপর ভিত্তি করে সমাজকাঠামোর সংজ্ঞা প্রদান করেন।
দ্বিতীয়ত, সমাজে বসবাস করতে গিয়ে মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য, মানুষের আচরণকে নিরসন করার জন্য নানারকম স্থায়ী ও অস্থায়ী সামাজিক গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। এসব গোষ্ঠীর সৃষ্টি না হলে সমাজের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেত। সুতরাং নানা ধরনের স্থায়ী ও অস্থায়ী সামাজিক গোষ্ঠী সমাজকাঠামোর অন্যতম উপাদান।
তৃতীয়ত, সমাজের মানুষের প্রয়োজনীয় কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রথা-প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রথা-প্রতিষ্ঠানের ক্রিয়াকর্মের ওপরই সমাজ টিকে আছে। কারণ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়েই মানুষের ভূমিকা প্রতিফলিত হয়।
crossorigin="anonymous">
style="display:block; text-align:center;"
data-ad-layout="in-article"
data-ad-format="fluid"
data-ad-client="ca-pub-3850092454288730"
data-ad-slot="2569077421">
উপরিউক্ত আলোচনা হতে বলা যায় যে, সমাজ গঠিত হয় সমাজের মানুষদের নিয়ে। তারা পরস্পরের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলে বিভিন্নরকম ভূমিকা পালন করে। সামাজিক পরিচিতি ও ভূমিকার ভিত্তিতেই বিভিন্ন ধরনের গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তাই এসব সামাজিক গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়েই সামাজিক কাঠামো সৃষ্টি হয়। তাহলে সমাজকাঠামোর উপাদানগত দিকের ওপর ভিত্তি করেও জিন্সবার্গের উক্তির যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যায়।
সমালোচকদের দৃষ্টিতে জিন্সবার্গের সংজ্ঞাঃ পুঁজিবাদী সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে জিন্সবার্গের সংজ্ঞাটিও অনেকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন। Bottomore এটাকে most useful বলে আখ্যা দেন। সেন বলেন, সংজ্ঞাটি অধিকতর বাস্তবসম্মত। তবে সেন Ginsberg-এর সংজ্ঞার মধ্যে কিছুটা অস্পষ্টতার কথা উল্লেখ করেছেন । কেননা তার মতে, সংজ্ঞাদাতা প্রতিষ্ঠান, সংঘ ও গোষ্ঠির প্রাধান্য কিভাবে নিরূপণ করা প্রয়োজন তা বলেননি। পক্ষান্তরে বটমোর এর মতে, প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠিসমূহকে চিহ্নিত করা খুব কঠিন কাজ বা ব্যাপার নয়। তা ছাড়া প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠী কোনগুলো সে সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে খুব কমই মতভেদ আছে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, ব্যক্তি ও গোষ্ঠিসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই সমাজকাঠামো গড়ে ওঠে এতে কোন সন্দেহ নেই । স্বাভাবিক অর্থে সমাজকাঠামো একটি বিমূর্ত প্রত্যয়। কিন্তু সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও অনুষ্ঠান- প্রতিষ্ঠানগুলো স্ব-স্ব ভূমিকা পালনের মাধ্যমে পরস্পরের সংস্পর্শে আসে এবং সামাজিক মানচিত্র ভেসে ওঠে একেই সমাজকাঠামো বলে। তাই জিন্সবার্গ প্রদত্ত সমাজকাঠামো সম্পর্কিত উক্তি যথেষ্ট গুরুত্বের পরিচয় বাহক।
Post a Comment