চৈতন্য জীবনী সাহিত্যের পরিচয় দাও এবং গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর


প্রশ্নঃ চৈতন্য জীবনী সাহিত্য সম্বন্ধে একটি নিবন্ধ রচনা কর।

অথবা, জীবনী সাহিত্য কী? মধ্যযুগে রচিত জীবনী সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও৷

অথবা, “চৈতন্যচরিত গ্রন্থসমূহ সমকালীন জীবন ও সমাজের আলেখ্য হিসেবেও মূল্যবান৷” এই মন্তব্যের আলোকে চরিত গ্রন্থসমূহের ঐতিহাসিক মূল্য নিরূপণ কর।

অথবা, চৈতন্য জীবনী সাহিত্যের পরিচয় দাও এবং গুরুত্ব ব্যাখ্যা কর।

উত্তরঃ কোন ক্ষণজন্মা সৃষ্টিশীল মহৎ মানুষের জীবনকে মুখ্য করে যে সাহিত্য নির্মিত হয়, তাকে জীবনী সাহিত্য বলে। জীবনী সাহিত্যে কল্পনার কোন স্থান নেই, ঘটনার অতিরঞ্জনও তাতে জায়গা পাবে না, ফলে জীবনী সাহিত্য নিতান্তই বস্তুনিষ্ঠ। যে ব্যক্তির জীবনকে ঘিরে জীবনী সাহিত্য রচিত হবে তার জন্ম-মৃত্যু, বংশ পরিচয়, শিক্ষা, কর্ম এবং তার প্রতিভার পরিপূর্ণ মূল্যায়নই জীবনী সাহিত্যের প্রধান অভিপ্রায়।

মধ্যযুগের সাহিত্য ধর্মাশ্রিত। দেবদেবীর স্তুতি, ধর্মকথা প্রচারই এ সাহিত্যের মূল লক্ষ্য। অনুবাদ সাহিত্যের মধ্যে কিছুটা মানবিকতা ও বস্তুনিষ্ঠতা লক্ষ্য করা গেলেও তা ধর্মের মোড়কে আবৃত। সুতরাং সে অর্থে মধ্যযুগে মৌলিক সাহিত্য রচিত হয় নি। সমগ্র মধ্যযুগে কেবল শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনকে অবলম্বন করে জীবনী সাহিত্য গড়ে ওঠে যা একমাত্র মৌলিক সাহিত্য পদবাচ্য। তবে আধুনিক যুগে জীবনী সাহিত্য বলতে আমরা যেমন ব্যক্তিত্ববান মানুষের ভাল-মন্দ, দোষ-গুণ, ভুল-ভ্রান্তি, উত্থান-পতন প্রভৃতি বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রত্যাশা করি, মধ্যযুগের জীবনী সাহিত্যে তা প্রত্যাশা করা নিরর্থক। তবুও মধ্যযুগের প্রথানির্ভর ধর্মাশ্রিত সাহিত্যের মধ্যে জীবনী সাহিত্যের মত একটি মৌলিক বস্তুবাদী সাহিত্য ধারা গড়ে উঠেছে, যা মর্ত্যের মানুষকে অবলম্বন করে, এখানেই এ সাহিত্যের অনস্বীকার্য নতুনত্ব ও গুরুত্ব।




style="display:block; text-align:center;"
data-ad-layout="in-article"
data-ad-format="fluid"
data-ad-client="ca-pub-3850092454288730"
data-ad-slot="2569077421">


বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের গতানুগতিক ধারায় জীবনী সাহিত্য এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। শ্রীচৈতন্যদেব ও তার কতিপয় শিষ্যের জীবন কাহিনী অবলম্বনে এ জীবনী সাহিত্যের সৃষ্টি। তবে এর মধ্যে চৈতন্য জীবনীই প্রধান। চৈতন্যদেব যে প্রেনধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছেন- তাতে মানুষে মানুষে, উঁচু-নীচু, হিন্দু-মুসলমানে জাত বিভেদ ভুলে সবাই প্রেমমন্ত্রে উদ্দীপ্ত হয়েছে। ফলে তার শিষ্যরা চৈতন্যের প্রেমধর্ম প্রচার করতে গিয়ে চৈতন্যের জীবনকাহিনী আলোচনা করতেন, তা থেকে জীবনী সাহিত্যের সূত্রপাত। ধর্মীয় বিষয় অবলম্বনে সাহিত্য সৃষ্টি মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য। চৈতন্য জীবনী সাহিত্যও এ বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত নয়। কারণ চৈতন্যকে অনেকেই অবতার হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, তাই তার জীবনীকাব্য ভক্তিকাব্য হয়ে পড়েছে। ভক্তের কাছে চৈতন্য ছিল নররূপী নারায়ণ। তাই তার জীবনচরিতে ভক্তি মিশ্রিত হয়ে বস্তুনিষ্ঠতা হারিয়ে, জীবনী গ্রন্থ হয়েছে দেব-অবতারের মঙ্গলপাঁচালী। তবে জীবনী রচয়িতারা নিজেদের দেশ-কাল উপেক্ষা করতে পারেন নি। ফলে ষোল শতকের শাস্ত্রিক সামাজিক ভৌগোলিক অবস্থা ও সাম্প্রদায়িক, প্রশাসনিক, নৈতিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থানের সংবাদচিত্র বহন করেছে চরিতোপাখ্যানগুলো; এর সর্বাধিক গুরুত্ব এখানেই।

জীবনী সাহিত্যের রচয়িতাগণের উদ্দেশ্য ছিল চৈতন্যদেবের মহান জীবনকাহিনী বর্ণনার মাধ্যমে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার ও এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের গৌরব প্রতিষ্ঠা করা। ফলে কাহিনীতে অলৌকিকতা এসেছে। তবে বিশেষত্ব এখানে যে, তারা সর্বপ্রথম মানুষের জীবন নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, বাস্তব মানুষ সাহিত্যের উপজীব্য হয়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এ জীবনী সাহিত্য দু'ভাগে বিভক্ত— ক. সংস্কৃত জীবনী খ. বাংলা জীবনী। 




style="display:block; text-align:center;"
data-ad-layout="in-article"
data-ad-format="fluid"
data-ad-client="ca-pub-3850092454288730"
data-ad-slot="2569077421">


ক. সংস্কৃত জীবনীঃ
 চৈতন্যদেবের প্রথম জীবনী রচিত হয় সংস্কৃত ভাষায়। নরহরি সরকার, রঘুনাথ দাস প্রমুখেরা চৈতন্য-বিষয়ক পদ রচনা করেন। চৈতন্যের প্রথম জীবনী লেখক মুরারি গুপ্ত বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী। ‘মুরারি গুপ্তের কড়চা’, নামে পরিচিত তাঁর কাব্যের প্রকৃত নাম ‘শ্ৰীশ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃত'। তিনি চৈতন্যের সমসাময়িক বলে অধিকাংশ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি চৈতন্যের সন্ন্যাস জীবন পর্যন্ত লিখেছিলেন। বাকিটা অন্যে শেষ করেছে। তবে কবি কর্ণপুর, বৃন্দাবনদাস, লোচনদাস, কৃষ্ণদাস কবিরাজ প্রমুখ কবিগণ জীবনী সাহিত্য লেখায় মুরারি গুপ্তের কাছে ঋণী কবি কর্ণপুর উপাধিধারী পরমানন্দ দাস সংস্কৃতে দু'খানি গ্রন্থ— ‘শ্রীচৈতন্যচন্দ্রোদয়' নাটক ও ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' মহাকাব্য রচনা করেন। স্বরূপ দামোদরও কাব্য রচনা করেছিলেন কিন্তু তার গ্রন্থখানি পাওয়া যায় নি। প্রবোধানন্দ স্বরস্বতী ‘শ্রীচৈতন্যচন্দ্রামৃত' নামে কাব্য রচনা করেছিলেন।




style="display:block; text-align:center;"
data-ad-layout="in-article"
data-ad-format="fluid"
data-ad-client="ca-pub-3850092454288730"
data-ad-slot="2569077421">


খ. বাংলা জীবনীঃ
চৈতন্যদেবের বাংলা জীবনীকাব্যগুলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালির জীবন, সমাজ ও সাধনা সম্পর্কিত অনেক মৌলিক ঐতিহাসিক তথ্য এসব গ্রন্থে বিধৃত। পদাবলী সাহিত্যের বিকাশে এগুলোর অবদান অনস্বীকার্য। বস্তুতপক্ষে চৈতন্যচরিত কাব্যগুলোর মাধ্যমে চৈতন্যের জীবনকথা, বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্ব ও রহস্য বাঙালির কাছে প্রচারিত হয়।

মধ্যযুগের চরিত সাহিত্য বা চৈতন্যচরিত গ্রন্থসমূহ নিম্নরূপ—

১. বৃন্দাবনদাসের ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত': বাংলা ভাষায় শ্রীচৈতন্যের প্রথম জীবনীকাব্য বৃন্দাবনদাসের ‘শ্রীচৈতন্য-ভাগবত'। কাব্যটির রচনাকাল ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দ। কবি তার গুরু নিত্যানন্দের কাছ থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করে কাব্যটি লিখেছেন। কবি চৈতন্য ও নিত্যানন্দকে কৃষ্ণ ও বলরামের অবতার জ্ঞান করেছেন। চৈতন্যের বাল্য ও কৈশোরলীলা বাস্তবতা ও সরলতা সহকারে বর্ণনা করেছেন। করুণ, কোমল, কঠোর ও পৌরুষদীপ্ত চৈতন্যকে কবি এঁকেছেন। চৈতন্যের মানব ও ভাগবতমূর্তি সমানভাবে কাব্যে বিধৃত। সমকালীন সমাজের বিবিধ দিক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে চিত্রিত। মানবীয় রস এ কাব্যের স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে। তত্ত্বজিজ্ঞাসু, দার্শনিক ও সাধারণ মানুষ সবাই তাঁর কাব্য থেকে বিশেষ রস আস্বাদন করতে পারে।




style="display:block; text-align:center;"
data-ad-layout="in-article"
data-ad-format="fluid"
data-ad-client="ca-pub-3850092454288730"
data-ad-slot="2569077421">


২. লোচনদাসের 'চৈতন্যমঙ্গল':
 কবি তার গুরু নরহরি সরকারের আদেশে ১৫৫০-৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাব্যটি রচনা করেন। কাব্যটি সাধারণ বিশ্বাসপ্রবণ বৈষ্ণবভক্তের জন্য রচিত এবং এর রচনাধারা অনেকাংশে মঙ্গলকাব্যের অনুরূপ। কাব্যে চৈতন্য জীবনের আদিরসাত্মক লীলার বর্ণনায় ঐতিহাসিকতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। তবে কবির কবিত্বশক্তির পরিচয় এ কাব্যে রয়েছে।

৩. জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল': ১৫৬০ সালের দিকে কাব্যটি রচিত। গতানুগতিকভাবে কাব্যটি জনসাধারণের জন্য রচিত বলে এতে ঐতিহাসিকতা ক্ষুণ্ন হয়েছে। কাব্যের রচনারীতি মঙ্গলকাব্য ও পৌরাণিক ধরনের। কাব্যটিতে কাব্যগুণ নেই, তাছাড়া বৈষ্ণব সমাজে সমাদর পায় নি। স্বাধীন রচনা হিসেবে কাব্যটি স্বতন্ত্রতা পেয়েছে।




style="display:block; text-align:center;"
data-ad-layout="in-article"
data-ad-format="fluid"
data-ad-client="ca-pub-3850092454288730"
data-ad-slot="2569077421">


৪. কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত':
চৈতন্য জীবনীকারদের মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজের কাব্য নানাদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বের আসন গেড়েছে। তার কাব্যের নাম 'শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত'। কাব্যটি কবির পাণ্ডিত্য, মনীষা, দার্শনিকতা ও রস মাধুর্যে অদ্বিতীয়। কবি ও কাব্যে চৈতন্যজীবনাদর্শ, ভক্তিবাদ, দ্বৈতবাদী দার্শনিক চিন্তায় বাঙালি মনীষার এক উজ্জ্বলতম স্মারক চরিত্র অঙ্কন করেছেন। কবি বৃদ্ধকালে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে কাব্যটি রচনা করেন। তার পূর্বে তিনি চৈতন্য অনুচরদের কাছ থেকে বৈষ্ণব সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। বৈষ্ণব সমাজে এ কাব্যটি উপনিষদের মর্যাদা পেয়েছে। এ গ্রন্থে মনন, দর্শন, তত্ত্বজ্ঞান এবং রসবোধের অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে।

৫. গোবিন্দদাসের ‘কড়চা': এ গ্রন্থটি নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। চৈতন্যদেবের দাক্ষিণাত্য ও পশ্চিম ভারত ভ্রমণ অবলম্বনে কাব্যটি রচিত। গোবিন্দদাস ছিলেন চৈতন্যদেবের তীর্থ ভ্রমণকারী ভৃত্য। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে জয়গোপাল গোস্বামী এ কাব্য প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থের প্রামাণিকতা সম্পর্কে সন্দেহ আছে।




style="display:block; text-align:center;"
data-ad-layout="in-article"
data-ad-format="fluid"
data-ad-client="ca-pub-3850092454288730"
data-ad-slot="2569077421">


৬. চূড়ামণিদাসের ‘গৌরাঙ্গবিজয়':
 ড. সুকুমার সেন এ কাব্যটি প্রকাশ করেছেন। কাব্যের অপর নাম ‘ভুবনমঙ্গল’। কাব্যটি খণ্ডিত। এতে চৈতন্যজীবনীর তথ্যগত ভুলভ্রান্তি আছে। সম্ভবত শ্রুত-স্মৃতি থেকেই কাব্যটি রচিত। বৈষ্ণব সমাজে কাব্যটি মোটেও আদর পায় নি। 

অন্যান্য গ্রন্থ: চৈতন্যদেবের কয়েকজন শিষ্যের জীবন নিয়েও কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছে। এর মধ্যে চৈতন্যশিষ্য অদ্বৈত, নিত্যানন্দ প্রমুখের জীবন নিয়ে কাব্য রচিত হয়েছে। হরিচরণ দাসের ‘অদ্বৈতমঙ্গল', ঈশান নাগরের ‘অদ্বৈত প্রকাশ' উল্লেখযোগ্য। গুরুচরণ দাস ও নরহরি চক্রবর্তী চৈতন্যদেবের শিষ্য শ্রীনিবাস ও নরোত্তমের জীবন নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন।

চৈতন্য জীবনী সাহিত্যের গুরুত্বঃ মধ্যযুগে যেখানে দেবস্তুতির বদলে প্রথমবারের মত মর্ত্যের কীর্তিমান মানুষের জীবনভিত্তিক বস্তুনিষ্ঠ কাব্য রচনার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ব্যক্তিজীবন ছেঁকে তুলতে গিয়ে সমকালীন আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবন তুলে আনায় বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে। শুধু চৈতন্যের ধর্মীয় জীবন নয়, তাকে কেন্দ্র করে যে সমাজ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে তার প্রভাব সমাজে এর প্রভাব সমাজে পতিত হয়েছে। ফলে এ সাহিত্যের গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া মধ্যযুগের এ সাহিত্যধারা পরবর্তী বস্তুনিষ্ঠ চরিত সাহিত্যের ভিত্তিভূমি হিসেবে এর মূল্যমান অনস্বীকার্য।

Post a Comment

Leave a Comment.